Skip to content

আমাদের ইহুদি-মিত্রদের কাছে খোলা চিঠি

উপনিবেশবাদ শত শত বছর ধরে নিজের নৃসংশতাকে বৈধতা প্রদানে ব্যক্তিপরিচয়কে হাতিয়ার বানিয়েছে। বর্তমানে ইহুদিবাদী জমিদস্যু-উপনিবেশিক প্রকল্পটি নিজেকে একটি ইহুদিকেন্দ্রিক প্রচেষ্টা বলে দাবি করে এবং ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার সংগ্রামকে ইহুদি-বিরোধী বলে দাবি করে। এজন্য আপনি, আমাদের প্রিয় ইহুদি মিত্রগণ, এই পরিস্থিতির একটি বাস্তব উন্নতি করতে পারবেন- একারণে আমরা এই চিঠি আপনাদেরকে সম্বোধন করে লিখেছি। প্রথমত শুধু কথায় নয়, বরং কর্মে আপনাদের মহৎ অবস্থান নেওয়ার জন্য আমরা আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা ফিলিস্তিনিদেরকে সর্বাধিক ব্যথিত করেছে তা শত্রুদের বোমা নয় – আমরা গত ৭৫ বছর ধরে দখলের অধীনে বসবাস করছি, আমরা এই ভয়াবহতার সাথে অন্তরঙ্গভাবে পরিচিত। আমাদের জন্য সর্বাধিক দুঃখজনক ও কষ্টকর হচ্ছে জনসমষ্ঠির নীরবতা। এই নীরবতার মধ্যে আপনাদের কন্ঠ, অগনিত অন্যদের সঙ্গে আপনাদের কান্না-বেদনা,আমাদের হৃদয় উষ্ণ করেছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, আপনাদের দ্বারা ইহুদিবাদকে অস্বীকার করা একটি নৈতিক অবস্থানের চেয়েও বড় কিছু: ইহুদিধর্মের সাথে মিশ্রিত হওয়ার চেষ্টা ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকে ইহুদি-বিরোধী বলার দুই মিথ্যাকে ফাঁস করে ইহুদিবাদের নকল বৈধতাকে ধ্বংস করে দেয়। তাই এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সত্য আপনার নির্ভীক রাজনৈতিক অবস্থানের সাথে আছে। শত শত বছর ধরে ইহুদিরা শান্তিতে ফিলিস্তিনিদের মাঝে, ফিলিস্তিনি হয়েই, ফিলিস্তিনে বসবাস করেছে। গাজা স্ট্রিপে পূর্বে একটি উদীয়মান ইহুদি কোয়ার্টার ছিল যার প্রশান্তি কেবল ফিলিস্তিনের উপর ইহুদিবাদের আগমনের পরেই বিনষ্ট হয়েছে। ইহুদিবাদী উপনিবেশ এই বিভাজনের জন্য দায়ী, ধর্মীয় তফাত কিংবা কোনো দুই মানবসভ্যতার যুদ্ধ নয়। বর্তমানে ফিলিস্তিনি হিসেবে আমাদের সংগ্রাম ইহুদিদের বিরুদ্ধে নয়, বরং সেই মতবাদের বিরুদ্ধে, যেটি এই সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করেছে এবং সেটিকে অস্ত্র বানিয়ে এই আধিপত্যবাদী প্রকল্পকে বৈধতা দিয়েছে। আমাদের লক্ষ্য “ফিলিস্তিন থেকে ইহুদিদেরকে তাড়িয়ে দেওয়া” নয়, এটি হচ্ছে বর্তমানের নামধারী ইহুদিকেন্দ্রিক রাষ্ট্র ও ইহার ক্ষমতার বেড়াজাল ভেঙ্গে দিয়ে তার পরিবর্তে স্থাপন করা ইহুদিবাদের মৌলিক বৈপরীত্য: একক, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র, নদী হতে সাগর পর্যন্ত। গণতান্ত্রিক, এটি সকল নাগরিকদের জন্য সমান অধিকার ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে; ধর্মনিরপেক্ষ, এটি সকলের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করবে এবং ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কোনো প্রকার বৈষম্য করবে না; ফিলিস্তিনি, এটি ফিলিস্তিনিদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অধিকার নিশ্চিত করবে, চূড়ান্তভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষ নির্মুল করবে এবং ইসরাইলের আগমনের পূর্বকালের সেই বৈচিত্র্যময় ফিলিস্তিনি সমাজকে ফিরিয়ে আনবে।

ন্যায়বিচারের প্রতি গভীর ভালোবাসায় দাঁড়িয়ে আপনারা এই স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হয়েছে, তা হোক ধর্মীয় বা মানবিক কারণে। আপনারা শুধু ফিলিস্তিনের পক্ষেই অবস্থান নেন নি, বরং আপনাদের নিজেদের সমাজের পক্ষেও। প্রকৃতপক্ষে,: উপনিবেশবাদের সাম্প্রদায়িক মনোভাব শুধু তার লক্ষ্য সমাজকেই বিভক্ত করে না, বরং তার উদ্ভাবিত এবং নিজের সমাজকেও বিভক্ত করে: যাদেরকে এটি লক্ষ্য করে, যেমনটি ফিলিস্তিনের ৭৫ বছরব্যাপী দুর্যোগে ঘটে যাচ্ছে , এবং আজকে গাজা পর্যন্ত; যাদেরকে তারা উদ্ভাবন করছে, যেমনটি আমরা ফিলিস্তিনের উপর আবাস-দখলকারীদের মধ্যে ধর্মীয়-অধর্মীয়, আশকেনাজি-মিজরাহি, শ্বেত-কালো সহ বিভিন্ন পরিচয়বাদী বিভেদ লক্ষ্য করতে পারি; এবং তারা যেই সমাজ থেকে উদ্ভূত, যেমনটি আমরা দেখতে পারি য়িদিশ, সেফারদিক ও আরব-ইহুদি সংস্কৃতি ধ্বংস করে রক্তারক্তি ও আতঙ্কের উপর একটি ইসরাইলি সংস্কৃতির উদ্ভাবন, এবং উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ জুড়ে উগ্র-ডানপন্থী দলসমূহের সাথে তার অপবিত্র বন্ধুত্বে। ইহুদি বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিকগণ কি ভয় পান না, যখন নেতানইয়াহু তাদেরকে বলে যে ইসরাইল তাদের বাসভূমি, ফ্রান্স নয়? ইউরোপীয় ইহুদিগণ কি এমন মতবাদ, আন্দোলন ও রাষ্ট কর্তৃক যথেষ্ট কষ্টভোগ করেননি, যাদের মতে ইহুদিগণ তাদের সমাজ না হয়ে অন্য সমাজের প্রাপ্য? “পশ্চিমী” রাজত্ববাদ ফিলিস্তিনে যা গড়ে তুলেছে –এবং অন্যান্য যেসব জায়গায় তা বিস্তার লাভ করেছে– তা সেখানে ধ্বংস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে সফলতা পেয়েছে। তারপরও তাদের পরিচয়বাদী অলঙ্করণ এক বড় মূল্যের বিনিময়ে এসেছে, এবং ইতিমধ্যেই তাদের নিজেদেরকেই এটি আঘাত করতে শুরু করছে।

এই দিক থেকে, ফিলিস্তিনের উপর স্থাপিত উপনিবেশ উত্তরণ করে এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র স্থাপনের সংগ্রাম শুধু ফিলিস্তিনেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং, এটি একটি আন্তর্জাতিক সংগ্রাম যার উৎপত্তি ফিলিস্তিনে কিন্তু এটি শুধু ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার মধ্য দিয়েই শেষ হবে না। গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেখা গেছে যে ফিলিস্তিনের দখল শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ নেই; দখলদার ভূমিদস্যু রাষ্ট্র ইসরাইল বিশ্বজুড়ে একটি রাজত্ববাদী অন্তর্জালের অংশ, যার উপনিবেশিক ক্ষমতার হাত যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র উৎপাদনকারী পুঁজিবাদীদের থেকে শুরু করে ইউরোপের পৌরসভাসমূহ, মেটা কোম্পানির আলগরিদম এবং “ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ” ও “আরব শাসক”দের পর্যন্ত বিদ্যমান। উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম সত্যিকারে মানবজাতির সংগ্রাম; এবং ইহায় আপনাদের আগমন কেবলমাত্র ফিলিস্তিনের পক্ষ্যে সম্প্রীতি প্রদর্শনের চেয়ে অনেক বড়: এটি বেঁচে থাকার জন্য একটি অবস্থান।

আমাদের সম্মিলিত সংগ্রামের প্রেক্ষিতে, অনুগ্রহ করে আমাদের পক্ষ থেকে দুটি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের একটি পরামর্শ নিন। প্রথমটি হচ্ছে তাৎক্ষণিক: গণহত্যা বন্ধের জন্য আপনাদের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করুন— যুদ্ধবিরতি এখনি। ইতিমধ্যে বিদ্যমান ও বিশ্বস্ত আন্দোলনগুলোর সাথে যুক্ত হয়ে যান। যেসব রাজনৈতিক দলসমূহ অন্যগুলোর চেয়ে কম ডানপন্থী সেগুলোতে আপনার ভূমিকা পালন করুন: তাদেরকে বিভক্তকরণের হুমকি দিন, তাদের নেতার উপর চাপ তৈরি করুন; তারা খুবই ভীতু এবং আপনাদের কথা মোতাবেক চলবে যদি আপনারা একতাবদ্ধ হয়ে চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে দীর্ঘকালীন। আমরা আপনাদেরকে অনুরোধ জানাই, আপনাদের সমাজের আসল ক্ষমতাধরদের চালান করা সাম্প্রদায়িক গুজবকে উপলব্ধি করতে; এবং কারা এই ক্ষমতাধর এবং তারা কিভাবে পরিচয়কে হাতিয়ার বানিয়ে আপনাদেরকে বিভক্ত করে থাকে তা চিনতে। সময়ের সাথে আমরা আশা করি আপনারা এমন রাজনৈতিক দলে যুক্ত হবেন যারা এই অশুভ বৈশ্বিক অনুশাসনকে নিশ্চিহ্ন করতে ব্রতী।

আপনারা যা কিছু করেছেন, প্রিয় মিত্রগণ, আমরা আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। আর আপনারা যা করতে যাচ্ছেন, আমরা আপনাদের সাথে সংযুক্ত থাকতে চাই; একটি নতুন বিশ্বের জন্য আমাদের একত্রিত সংগ্রাম সমন্বয় করতে: একটি বিশ্ব যেখানে ফিলিস্তিন এবং অন্যান্য প্রত্যেকটি সমাজ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ও পুঁজিবাদী নীলনক্সা থেকে মুক্ত; একটি উত্তর-উপনিবেশিক, গণতান্ত্রিক, সাম্প্রীতিক, ন্যায্য ও স্বাধীন বিশ্ব।

14469 জন এই চিঠি স্বাক্ষর করেছেন। আপনি এবং নিবন্ধন করে আপনার নিজের নামও সংযুক্ত করতে পারবেন